গর্ভ ভাড়ার রমরমা ব্যাবসা
================
নিঃসন্তান দম্পতিরা সন্তান উৎপাদনের জন্য নারীর গর্ভাশয় ভাড়া নিয়ে থাকেন। ভারতে নারীদের গর্ভাশয় ভাড়া দেওয়া নিয়ে রীতিমতো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। স্বল্প খরচে গর্ভাশয় ভাড়া পাওয়ার সুবাদে বিদেশি নাগরিকদের ভারত সফরের হার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে। আর এই ‘গর্ভ ভাড়া’র বিনিময়ে চলছে কোটি কোটি ডলারের রমরমা ব্যবসা।MAGI DER PHOTO
ভারতে গর্ভ ভাড়া দেয়া লক্ষ কোটি ডলারের এক লাভজনক বাণিজ্য হলেও সেটা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত আইনবিধি না থাকায় গর্ভভাড়া দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে গরিব নারীদের। আর এসব অর্থ লোভে আশায় গর্ভ ভাড়া দেওয়া গরিব মায়েরা জানেনও না, এতে তাঁদের স্বাস্থ্যের ওপর কতটা প্রভাব পড়তে পারে৷ আর এ ক্ষেত্রে নৈতিকতার কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক দ্য হিন্দুর অন লাইন সংস্করণ এসব খবর দিয়েছে।MAGI DER PHOTO
পত্রিকাটি বলছে, ভারতের ‘দুধের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত গুজরাট রাজ্যের আনন্দ শহর গর্ভ ভাড়ার ব্যবসায় শীর্ষে রয়েছে। শুধু তাই নয়- শহরটি এখন ‘ফার্টিলিটি ক্লিনিক কাম হোস্টেলে’ পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে দ্য হিন্দু। এ শহরের ‘আকাঙ্ক্ষা ফার্টিলিটি ক্লিনিক’ গর্ভ ভাড়া দেয়ার মাধ্যমে ৫শ’তম শিশু জন্মের উৎসব পালন করেছে গত বছরই। এ উপলক্ষে ক্লিনিকটি ভারতের প্রধান দৈনিকগুলোর প্রথম পাতায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে।MAGI DER PHOTO
গর্ভ ভাড়া দেবার লাভজনক বাণিজ্যের বিশাল বাজার যেহেতু ভারতে অনিয়ন্ত্রিত, তাই এতে থাকে নানা অনিয়ম ও অনৈতিক পন্থা, বিশেষ করে গর্ভ ভাড়া দেয়া মায়ের স্বাস্থ্য ও অন্য অধিকার, শিশুর লিঙ্গ নির্বাচন, গর্ভজাত শিশুর স্বাস্থ্য, ভবিষ্যত ও নাগরিকত্ব ইস্যুর নানা অসুবিধা ও জটিলতা৷
ভারতে গর্ভ ভাড়ার মাধ্যমে যেসব সন্তান জন্ম দেয়া হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই তুলে দেয়া হয় বিদেশি দম্পতির হাতে। এ ব্যবসার মধ্যদিয়ে কোটি কোটি ডলার আয় করা হলেও গর্ভধারণকারী ভারতীয় নারী একবার গর্ভ ভাড়ার বিনিময়ে সাড়ে তিন লাখ রুপির বেশি পান না। অবশ্য, যমজ সন্তান জন্ম দিলে গর্ভ ভাড়া দানকারী নারীকে আরো ২০ শতাংশ বেশি অর্থ দিতে হয়। কিন্তু, এভাবে একটা সন্তান পেতে হলে দম্পতিকে গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ রুপি খরচ করতে হয়। MAGI DER PHOTOএ ছাড়া, গর্ভকালীন এ ধরনের নারীদেরকে এক প্রতি মাসে মাত্র এক হাজার রুপি দেয়া হয়। সবচেয়ে উদ্বেগের দিকটি হচ্ছে- গর্ভকালীন কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা সামাল দেয়ার জন্য কোনো বীমার ব্যবস্থা নেই।
এই অনিয়ম দূর করতে ২০০৮ সালের অ্যাসিস্টেট রিপ্রোডাকটিভ টেকনোলজি সংক্ষেপে এআরটি বিলের প্রথম খসড়াটি সংশোধন করা হয় ২০১০ সালে৷ সেটির চূড়ান্ত অনুমোদন আইন মন্ত্রণালয় থেকে না আসায়, বিলটি আরো বিশদে খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছে এক বিশেষজ্ঞ কমিটি৷
গর্ভ ভাড়া দেয়া মায়ের এবং তাঁর গর্ভজাত সন্তানের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যত সুরক্ষিত রাখার সামাজিক তথা আইনি অধিকার সুনিশ্চিত করতে আরো কী কী করণীয় তার সুপারিশ করবে ঐ কমিটি, যার ভিত্তিতে বিলের একটি নতুন খসড়া তৈরি করা হবে৷ এজন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে৷ জানা গেছে, ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, ভারতের চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ, পরিকল্পনা কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্বয়ংসেবক সংস্থাগুলি এ সংক্রান্ত নতুন এই বিলের খসড়া চূড়ান্ত করবে৷ এক্ষেত্রে শলা-পরামর্শের মধ্যে সমন্বয়বিধান করবে পরিকল্পনা কমিশন৷MAGI DER PHOTO
এবিষয়ে ভারতের সিপিআই-এম নেতা বৃন্দা কারাত বলেছেন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গর্ভ ভাড়া দেয়ার সঙ্গে নৈতিকতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি আরো বলেন, ফার্টিলিটি ক্লিনিকগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য ভারতে কোনো কার্যকর আইন না থাকা সরকারের দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতার পরিচয় এবং সরকারের জন্য গভীর লজ্জার বিষয়।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চের পুরানো নির্দেশিকায় বলা হয়েছে যে, গর্ভ ভাড়া দেবার আগে সংশ্লিষ্ট পক্ষ, অর্থাৎ যিনি শুক্রাণু দেবেন এবং যে মহিলার গর্ভে তা প্রতিস্থাপন করা হবে, তাঁদের মধ্যে চুক্তি থাকবে৷MAGI DER PHOTO সেখানে শুধু মহিলার নয়, মহিলার স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের সম্মতি থাকবে হবে৷ গর্ভধারণ থেকে প্রসব পর্যন্ত যাবতীয় খরচ বহন করতে হবে ডোনার বা দাতা ব্যক্তিকে৷ প্রসবের পর সন্তানকে তুলে দিতে হবে সেই দম্পতির হাতে যাঁরা গর্ভ ভাড়া নিয়েছেন৷ এই কাজ বাণিজ্যিকভাবে করা নিষিদ্ধ৷
সন্তান জন্মের আগেই যদি নিঃসন্তান ঐ দম্পতির একজনের মৃত্যু হয় বা তাঁদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং সেক্ষেত্রে যদি কেউ নিতে না চায়, তাহলে সন্তান পালনের আর্থিক সংস্থান রাখা হবে৷ শুধু তাই নয়, গর্ভ ভাড়া দেয়া মায়ের স্বাস্থ্য বিমা করে দিতে হবে৷
গর্ভ ভাড়া নিঃসন্তান দম্পতিদের বড় সান্ত্বনা৷ MAGI DER PHOTOবিভিন্ন দেশে কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থার সুবিধা আছে৷ কিন্তু ভারতে এর চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে৷ কারণ এখানে গরিব মায়েরা কম খরচে সহজলভ্য৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরজন্য খরচ হয় যেখানে ৪০-৪৫ লাখ টাকা ভারতে সেখানে খরচ হয় ১৫-২০ লাখ টাকা৷ ডাক্তারি খরচ বাদ দিয়ে গর্ভ ভাড়া দেয়া মা বা তাঁর পরিবার পায় তিন থেকে চার লাখ টাকা৷
তবে ভাড়া নেয়া গর্ভজাত সন্তানের নাগরিকত্ব নিয়ে আইনি জটিলতা এখনো কাটেনি৷ কয়েক বছর আগে এক নিঃসন্তান জার্মান দম্পতিকে এক গুজরাটি মহিলা গর্ভ ভাড়া দিয়েছিলেন৷MAGI DER PHOTO যমজ সন্তানের জন্মের পর শিশুর নাগরিকত্ব নিয়ে আইনি জটিলতার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি৷ গুজরাট হাইকোর্ট যমজ শিশুকে দেন ভারতীয় নাগরিকত্ব৷ কারণ ভারতে দ্বৈত নাগরিকত্ব আইন নেই৷ জার্মান দম্পতি সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন৷ অবশ্য ঐ যমজ শিশুকে যাতে জার্মানিতে পাঠানো যায়, তার জন্য দু’দেশের সরকার সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে৷